বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে চলা বিক্ষোভ দমনে নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছিলেন বলে বিবিসির অনুসন্ধানে জানা গেছে।
বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, একটি ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিং যাচাই করে তারা জানতে পেরেছে, শেখ হাসিনা নিজেই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীদের দেখা মাত্র গুলি করার। ওই রেকর্ডিংয়ে শেখ হাসিনাকে একজন অজ্ঞাতপরিচয় ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে শোনা যায়, যেখানে তিনি বলেন, “যেখানেই তাদের (আন্দোলনকারী) পাবেন, গুলি করবেন।”
বিবিসির তথ্যমতে, এই ফোনালাপটি ২০২৩ সালের ১৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে করা হয়েছিল। রেকর্ডিংটি কে ফাঁস করেছে, তা এখনো জানা যায়নি, তবে এটি ২০২৪ সালের মার্চের দিকে অনলাইনে প্রকাশিত অডিওগুলোর মধ্যে অন্যতম।
ফাঁস হওয়া অডিওটির সঙ্গে শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বরের মিল শনাক্ত করেছে বাংলাদেশের পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। একইসঙ্গে, অডিওর নিরপেক্ষ যাচাইয়ের জন্য বিবিসি এটি ফরেনসিক অডিও বিশ্লেষণে যুক্তরাজ্যভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ‘ইয়ারশট’-কে দেয়।
ইয়ারশটের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, রেকর্ডিংটির ছন্দ, স্বর, শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ও নয়েজ বিশ্লেষণ করে তারা নিশ্চিত হয়েছেন এতে কোনো ধরনের সম্পাদনা বা কারসাজি করা হয়নি। তারা আরও জানান, রেকর্ডিংয়ের পটভূমিতে বিদ্যুৎচালিত নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি ধরা পড়েছে, যা রেকর্ডিংয়ের প্রামাণ্যতা নির্দেশ করে।
ব্রিটিশ মানবাধিকার আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান, যিনি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন, বিবিসিকে বলেন—“এই রেকর্ডিংগুলো শেখ হাসিনার ভূমিকা প্রমাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত এবং অন্যান্য তথ্যপ্রমাণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।”
আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বিবিসির উল্লেখ করা টেপটি সত্য কি না, তা তারা নিশ্চিত নন। সেই সঙ্গে এই রেকর্ডিংয়ে বেআইনি কিছু বলা হয়েছে, এমন প্রতিক্রিয়া জানাতে তারা বিরত থাকেন।
অন্যদিকে, ২০২৩ সালের আন্দোলনের পর থেকে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও বাংলাদেশের আদালতে একাধিক মামলা বিচারাধীন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে ২০৩ জনকে অভিযুক্ত করেছে, যাদের মধ্যে ৭৩ জন গ্রেপ্তার রয়েছেন।
বিবিসি আইয়ের অনুসন্ধান বলছে, এই অডিও ফাঁস প্রমাণ করে, আন্দোলনের সময় প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের নীতিগত সিদ্ধান্ত এসেছিল শীর্ষ পর্যায় থেকেই—যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।
বিবিসি বাংলায় যাত্রাবাড়ীর ঘটনা নিয়ে বলা হয়েছে, অনুসন্ধান চলাকালে ঘটনার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও বিবিসি’র হাতে আসে, যেখানে পাঁচই অগাস্ট বিকেলে যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিবর্ষণ শুরুর কিছু মুহূর্ত দেখা যায়।
ভিডিওটি এমন একজন আন্দোলনকারীর মোবাইল ফোন থেকে বিবিসি সংগ্রহ করেছে, যিনি নিজেও সেদিন পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। নিহত ওই আন্দোলনকারীর নাম মিরাজ হোসেন।
পুলিশ যখন বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে, সেই সময়ের ভিডিও ধারণ করেছেন মিরাজ হোসেন। মর্মান্তিকভাবে মোবাইল ক্যামেরায় ওই ভিডিওতে তার জীবনের শেষ মুহূর্তও ধরা পড়েছে।
তার মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যরা তার মোবাইলটি খুঁজে পান এবং ফোনে সংরক্ষিত ভিডিওটি বিবিসিকে দেন।
ভিডিও’র মেটাডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেদিন নির্বিচারে গুলিবর্ষণের ঘটনাটি শুরু হয়েছিল দুপুর দুইটা ৪৩ মিনিটে।
ভিডিওটিতে যাত্রাবাড়ী থানার মূল ফটকে বিক্ষোভকারীদের সামনে সেনাবাহিনীর একটি দলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এরপর হঠাৎ করেই তারা ওই এলাকা থেকে সরে যান।
এ ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই যাত্রাবাড়ী থানার ভেতরের পুলিশ সদস্যরা ফটকের সামনে অবস্থানরত বিক্ষোভকারী জনতার ওপর আকস্মিকভাবে গুলিবর্ষণ শুরু করেন।
থানার উল্টো দিকে অবস্থিত একটি ভবনের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ গুলি চালানো শুরু করার পর প্রাণ বাঁচাতে গলির ভেতর দিয়ে ছুটে পালাচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা। ওই সময়ের আরেকটি ভিডিওতে আহতদের শরীরে লাথি মারতেও দেখা যায় পুলিশকে।
অনুসন্ধানে বিবিসি দেখেছে যে, পাঁচই অগাস্ট বিকেলে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল। ঘটনার সময়ের কিছু ড্রোন ভিডিও বিবিসি’র হাতে এসেছে।
ভিডিও’র মেটাডেটার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিকেল তিনটা ১৭ মিনিটেও যাত্রাবাড়ী থানার সামনের মহাসড়কে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাচ্ছিলো পুলিশ।
এরপর তাদের বড় একটি দলকে থানার উল্টো পাশে অবস্থিত একটি অস্থায়ী সেনা ব্যারাকে আশ্রয় নিতে দেখা যায়। ড্রোন ভিডিওতে মহাসড়কের ওপর হতাহতদের একাধিক মৃতদেহ পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। ভ্যান-রিকশা এবং বাইকে করে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন আন্দোলনকারীরা।
পরবর্তী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ শাহবাগের দিকে চলে যান। আর যারা তখনও যাত্রাবাড়ীতে ছিলেন, তাদের মধ্যে বিক্ষুব্ধ একটি অংশ থানায় আগুন দেন। এ ঘটনায় পুলিশের কমপক্ষে ছয়জন সদস্য নিহত হন।
পাঁচই অগাস্ট বিকেলে পুলিশের নির্বিচার গুলির ঘটনার পর আহতদেরকে আশেপাশের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা বহু ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করেন।
সেদিন যাত্রাবাড়ীতে অন্তত ৩০ জন বিক্ষোভকারী নিহত হন বলে প্রাথমিকভাবে জানা যাচ্ছিলো।
কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত তখনকার খবর, নিহতদের পরিবারের সাক্ষাৎকার, হাসপাতালের নথি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন পোস্টের সত্যতা যাচাই করার পর বিবিসি দেখেছে, পাঁচই অগাস্ট যাত্রাবাড়ীতে কমপক্ষে ৫২ জন সাধারণ মানুষ নিহত হন। এর বাইরে সেদিন আরো অন্তত ছয়জন পুলিশ নিহত হন।
পাঁচই অগাস্টের ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা হয়েছে। এর মধ্যে থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসানের বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হয়েছে, যিনি হত্যাকাণ্ড চলাকালে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
পুলিশ বাহিনী জানিয়েছে, তারা ঘটনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন।
“বাংলাদেশ পুলিশ এরইমধ্যে পুঙ্খানুপুঙ্খ ও নিরপেক্ষভাবে বিষয়টির তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে। গণআন্দোলন সংক্রান্ত যাবতীয় ফৌজদারি মামলা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে, যাতে ঘটনার সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায়,” এক ই-মেইল বার্তায় বিবিসিকে বলেছে বাংলাদেশ পুলিশ।
ওই ঘটনার সময় সেনা সদস্যদের ভূমিকার বিষয়ে মন্তব্য জানতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
%e0%a6%9c%e0%a7%81%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%87%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a7%87-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%a3%e0%a6%98%e0%a6%be%e0%a6%a4%e0%a7%80-%e0%a6%b6%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf
Leave a Reply