বিপর্যয় নয়, এবারের ফল বর্তমান বাস্তবতা

২০২৫ সালের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) এবং সমমান (দাখিল ও কারিগরি) পরীক্ষায় পাসের হার ও জিপিএ কমেছে। ২০০৯ সালের পর ফল এমন নিচের দিকে দেখা যায়নি। তবে এটিকে ফল বিপর্যয় বলতে চান না শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।

বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) ২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। ফলে দেখা গেছে, জিপিও কমে অর্ধেকেরও নিচে নেমেছে। আর পাসের হার গত বছরের চেয়ে কমেছে ১৫ শতাংশ। এছাড়া পরীক্ষায় অংশ নিয়েও পাস করতে পারেনি ৬ লাখ ৬৬০ পরীক্ষার্থী।

ফলের এই পরিস্থিতি কেন জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাধায়ক সরকারে উপদেষ্টা শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি এটিকে ফল বিপর্যয় বলতে চাই না। এটাই বর্তমান সময়ের রিয়ালিটি। তবে খারাপ হওয়ার কারণ এবার গ্রেস মার্ক দেওয়া হয়নি। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। সরকার গঠনের পরও আন্দোলন চলেছে, যে যার মতো করে আন্দোলন করেছে সেটি আরেকটি কারণ। মেয়েদের ফল এবারও ভালো। তার মানে ফলে মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। তাছাড়া যারা খারাপ করতো তারাই খারাপ করেছে।’ 

খারাপ ফলের জন্য শিক্ষক স্বল্পতাকেও দায়ী করেছেন রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘কোনও শিক্ষার্থী পাস করেনি এর সংখ্যা বেড়েছে। গণিত, বিজ্ঞান ইংরেজিতে মফস্বলে সংকট। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। অতএব দৃষ্টি দিতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে।’

রাশেদা কে চৌধুরী আরও বলেন, ‘অনেক শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রশন করেও পরীক্ষা দেয়নি। যাদের প্রস্তুতি একেবারেই ছিল না তারা পরীক্ষা দেয়নি। অনিশ্চিত একটা অবস্থা তো ছিলই। হয়তো সে কারণে প্রস্তুতি ছিল না। এছাড়া বাল্যবিবাহ ও শ্রমে জড়িত হওয়ার কারণ রয়েছে, সেটি খুঁজে বের করতে হবে। তবে কেন খারাপ হলো তা গবেষণা করে দেখা দরকার। তা না হলে খারাপ হতেই থাকবে।’

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি এটিকে ফল বিপর্যয় বলবো না। ফল কেন খারাপ হলো তা গবেষণা করে বলা যাবে। এ বছর যে ফল এসেছে তা রিয়ালিটি। এবার গ্রেস মার্কিং করা হয়নি। সে হিসেবে যা ফল আসার কথা সেটাই এসছে। তবে জুলাই-আগস্টের প্রভাব ফলে পড়তে পারে। শিক্ষার্থীরা ট্রমার মধ্যে ছিল। এখনও পুরোপুরি ট্রমা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া সিলেটে এবার বন্যা ছিল, সেসব বিবেচনায় ফল প্রত্যাশিত।’

ফল প্রকাশের পর পাসের হার ও জিপিএ-৫ এত কমেছে কেন জানতে চাইলে বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ড. খন্দোকার এহসানুল কবির জানান, এ বছর কোনও ওভারমার্কিং বা আন্ডারমার্কিং করা হয়নি। নম্বর বেশি বা কম দেওয়ার কোনও নির্দেশনা ছিল না। যার যা প্রাপ্য, তাকে তাই দেওয়া হয়েছে। ফলে এর প্রভাব পড়তে পারে।

তবে সংশ্লিষ্টদের অনেকেই বলছেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর বেশ কয়েক মাস শিক্ষার্থীরা ট্রমার মধ্যে ছিল। তারা ঠিকমতো সিলেবাস শেষ করতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দেওয়া ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল, এসব নানা কারণেই পরীক্ষায় অপেক্ষাকৃত খারাপ করেছে শিক্ষার্থীরা।

জানতে চাইলে শিক্ষা গবেষক ও উন্নয়নকর্মী কে এম এনামুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একদিকে কোভিড অতিমারির প্রভাবে শিশুদের মধ্যে একটি বড় ধরনের শিখন ঘাটতি ছিল। তার ওপর ২০২৪ এর অভ্যুথানকালীন ও পরবর্তী সময়ে অস্থিরতা, পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নে চ্যালঞ্জসহ শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলে। প্রস্তুতির অভাবে পরীক্ষা না দেওয়ার জন্যও অনেক শিক্ষার্থী দাবি জানাচ্ছিল, তারা প্রস্তুতির সময় পায়নি। এসব প্রভাব ফলে পড়েছে।’     

ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সর্বশেষ ২০০৯ সালে সবচেয়ে কম পাস করে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায়। ২০০৯ সালে পাস করেছিল ৫৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এর পর থেকে প্রতি বছরই ফল নিচে নামেনি। ২০২১ সালে রেকর্ড পরিমাণ শিক্ষার্থী পাস করে। সে বছর পাস করেছিল ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

সর্বশেষ ২০২৪ সালের পরীক্ষায় পাস করে ৮৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এবার পাস করেছে ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ, কমেছে ১৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

গত পাঁচ বছরের তুলনায় এ বছর জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে অর্ধেকের বেশি। ২০২০ সালে এক লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন, ২০২১ সালে এক লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন, ২০২২ সালে জিপিএ-৫ পায় ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন। সর্বশেষ ২০২৪ সালে জিপিএ-৫ পায় এক লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন। এ বছর জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন। এবার জিপিএ-৫ কম পেয়েছেন ৪৩ হাজার ৯৭ শিক্ষার্থী।

উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস

ভালো করা বোর্ডের ফল নিম্নগামী

ফল বিশ্লেষণে দেখা যায় এ বছর ফলে সর্বোচ্চ এগিয়ে রয়েছে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড। পাসের হার ৭৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে এই শিক্ষা বোর্ডটিতে কেউ পাস করেনি এমন প্রতিষ্ঠান নেই। 

পাসের হার কমেছে ১৫ শতাংশ

সারা দেশে পাসের হার কমেছে ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ২০২৪ সালে পাসের হার ছিল ৮৩ দশমিক ৪ শতাংশ। সেই হিসাবে এবার পাসের হার ১৫ শতাংশ কমেছে।

ফলে দেখা যায়, ২০২৪ সালে ২০ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৭ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৬ লাখ ৭২ হাজার ১৫৩ জন পাস করে। তবে এ বছর ১৯ লাখ ৪ হাজার ৮৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ১২ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ জন।

সাদামাটা ফল প্রকাশ

রাজনৈতিক সরকারের সময়ে প্রতিবছর ঘটা করে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হলেও এবার তা হয়নি। রেওয়াজ অনুযায়ী কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষামন্ত্রী ফলের সার-সংক্ষেপ তুলে ধরতেন। এবার কেন্দ্রীয়ভাবে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা বোর্ডে ফল প্রকাশ করেছেন। 

পিছিয়ে পড়েছে বরিশাল

পাসের হারের দিক থেকে এ বছর সবার নিচে বরিশাল। বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে এবার পাসের হার ৫৬ দশমিক ৩৮। পাসের এই হার অন্যান্য বোর্ডের তুলনায় সর্বনিম্ন। শুধু তাই নয় বিগত কয়েক বছরের চেয়ে কম। 

বরিশাল ছাড়াও ফলে ধস নেমেছে ময়মনসিংহ বিভাগে। এই বিভাগে এবারের পাসের হার ৫৮.২২ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় এবার এই বোর্ডে পাসের হার কমেছে ২৬.৭৫ শতাংশ।

অন্যান্য বোর্ডের পাসের হার

ঢাকা বোর্ডে ৬৭ দশমিক ৫১ শতাংশ, রাজশাহীতে ৭৭ দশমিক ৬৩, কুমিল্লায় ৬৩ দশমিক ৬০ শতাংশ, যশোরে ৭৩ দশমিক ৬৯, দিনাজপুরে ৬৭ দশমিক ০৩ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৫৮দশমিক ২২ শতাংশ, বরিশাল বোর্ডে ৫৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ, বিআইএসই বোর্ডে ৬৮ দশমিক ০৪, মাদ্রাসা বোর্ডে ৬৮ দশমিক ০৯ এবং কারিগরি বোর্ডে ৭৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ পাস করেছেন।

গণিতের ফল নিম্নমুখী

এবারের এসএসসি পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি ফেল করেছে গণিতে। প্রায় ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী এই বিষয়ে পাস নম্বর তুলতে পারেননি। এরপর ফল খারাপ করেছে ইংরেজি বিষয়ে। সব বোর্ড মিলিয়ে গণিতে বিষয়ে পাস করেছে ৭৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ পরীক্ষার্থী। যেসব বোর্ড এ বছর পাসের হারে পিছিয়ে রয়েছে, সেসব বোর্ডের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি খারাপ করেছে গণিতেই।

এবারও এগিয়ে মেয়েরা

এবারও ফলে এগিয়ে রয়েছে মেয়েরা। এবার সব শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রী বেশি পাস করেছে ৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। আর ছাত্রদের চেয়ে ৮ হাজার ২০০ জন ছাত্রী বেশি জিপিএ-৫ পেয়েছে।

দেশের সব শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মোট ১৯ লাখ ২৮ হাজার পরীক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেয়। এতে উত্তীর্ণ হয় ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ জন। এ বছর পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন।

এবার পরীক্ষায় অংশ নেওয়া মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৩০ হাজার ৮৮টি। মোট ৩ হাজার ৭১৪টি কেন্দ্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আর ২০২৪ সালে মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল ২৯ হাজার ৮৬১টি। মোট তিন হাজার ৭৯৯টি কেন্দ্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। 


%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%a8%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%8f%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%ab%e0%a6%b2-%e0%a6%ac%e0%a6%b0

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *