রাজধানীর দুই সিটিতে ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম ১১ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৭৭৩ জন, যা পুরো জুন মাসের তুলনায় বেশি। চলতি মাস শেষে কিংবা আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৫৪ জন। এদের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ২২ জন এবং উত্তর সিটিতে ৫ জন। বাকি মৃত্যু হয়েছে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মহামারির রূপ নিতে পারে।
১৩টি ওয়ার্ড বিপজ্জনক
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) ফেব্রুয়ারির এক জরিপ অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মোট ১৩টি ওয়ার্ডকে ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উত্তর সিটির ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ড: ২, ৮, ১১, ১২, ২২, ৩৪। দক্ষিণ সিটির ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ড: ৩, ৪, ২২, ৩১, ৪১, ৪৬, ৪৭। এই তালিকার ভিত্তিতে দুই সিটি করপোরেশন কিছু কার্যক্রম হাতে নিলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিটি করপোরেশনের দাবি
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, “আমরা ২৫টি ওয়ার্ডকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ধরে মশার উৎস ধ্বংসে কাজ করছি। পানি জমে থাকে এমন স্থানে ‘নোভালুরন’ ট্যাবলেট প্রয়োগ করছি।”
অন্যদিকে, দক্ষিণ সিটির অতিরিক্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নিশাত পারভীন বলেন, “প্রতিদিন আক্রান্তদের তথ্য বিশ্লেষণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ১০টি অঞ্চলে তদারকি দল গঠন করা হয়েছে যারা মশা নিধনের কার্যক্রম, কীটনাশক প্রয়োগ এবং বাড়ি পরিদর্শন কার্যক্রম তদারকি করছে।”
তবে মশকনিধন কার্যক্রমে অদক্ষতা, ভুল লক্ষ্য নির্ধারণ এবং দায়সারা মনোভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকেরা।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, “মেয়র আসে, মেয়র যায়, আশ্বাসও মেলে কিন্তু ডেঙ্গু যায় না। কারণ, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে কিউলেক্স নয়, লক্ষ্য রাখতে হবে এডিস মশার ওপর। কিন্তু সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ কার্যক্রম ডোবা, নালা ও নর্দমার কিউলেক্স মশা টার্গেট করে চলে।”
তিনি বলেন,“এডিস মশা জন্মায় ঘরের ভিতর, ছাদে, ছোট পাত্রে জমা পানিতে, নির্মাণাধীন ভবনে। এসব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে ডেঙ্গু ছড়াবেই।”
অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, “ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ‘হোম টু হোম’ অ্যাপ্রোচে যেতে হবে, যাকে আমরা চিরুনি অভিযান বলি। প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে লার্ভা খুঁজে ধ্বংস করতে হবে। প্রথমবার ও দ্বিতীয়বার সতর্ক, এরপর জরিমানা করতে হবে। সিঙ্গাপুরের মতো সফল দেশগুলো এমন ব্যবস্থাই অনুসরণ করছে।”
নাগরিক উদাসীনতা ও চ্যালেঞ্জ
সিটি করপোরেশনের ৬৫ নম্বর ওয়ার্ড মশানিধনকর্মী আবুল কাসেম অভিযোগ করে বলেন, “তারা অনেক ভবনে প্রবেশ করতে পারেন না। বাড়ির মালিকেরা সহযোগিতা করেন না। এছাড়া বাসাবাড়ির ছাদ ও বেজমেন্ট পর্যবেক্ষণ করাও বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, “এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একদিকে যেমন সিটি করপোরেশনের কার্যকর ভূমিকা জরুরি, অন্যদিকে তেমনি নাগরিকদেরও সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে।”
অধ্যাপক বাশার বলেন, “শুধু সিটি করপোরেশন দিয়ে ডেঙ্গু ঠেকানো যাবে না। নাগরিকদের সম্পৃক্ত করা ছাড়া টেকসই কোনো সমাধান সম্ভব নয়।”
মৃত্যু আর আতঙ্কে দিন কাটছে
রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন সামিরা আক্তার ও তার মেয়ে মেহেরিমা। মা-মেয়ে দুজনেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে খাটের সংকট, নার্সদের ব্যস্ততা, পরীক্ষা ও ওষুধের চাপ। সব মিলিয়ে একটি অসহনীয় চিত্র।
চিকিৎসকেরা বলছেন, রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। অনেকে দেরিতে হাসপাতালে আসছেন, ফলে মৃত্যু ঝুঁকিও বাড়ছে।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় করণীয়
উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে লার্ভা ধ্বংস করা। নির্মাণাধীন ভবনে নজরদারি করা। জনগণকে সচেতন ও জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা।ওষুধ প্রয়োগে লক্ষ্যবস্তু ঠিক করা করা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা শফিউল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি সংকট নয়, এটি এখন শহুরে দুর্যোগ। চিকিৎসক, মশকনিধনকর্মী ও নাগরিক সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অন্যথায়, আগস্ট-সেপ্টেম্বর হবে মৃত্যুর মাস।
%e0%a6%a1%e0%a7%87%e0%a6%99%e0%a7%8d%e0%a6%97%e0%a7%81%e0%a6%b0-%e0%a6%89%e0%a6%9a%e0%a7%8d%e0%a6%9a-%e0%a6%9d%e0%a7%81%e0%a6%81%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%87-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c
Leave a Reply