দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাল্টে যাওয়া ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ যেন কোনও শক্তিধর রাষ্ট্রের ছককাটা স্বার্থের ফাঁদে না পড়ে– এই আহ্বান জানিয়ে বিশিষ্ট কূটনীতিক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদরা বলেছেন, স্বাধীন, বহুমুখী ও দূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতি এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে, রাখাইনে জাতিসংঘের প্রস্তাবিত ‘মানবিক করিডোর’ প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সতর্ক ও কৌশলী হতে হবে।
শনিবার (৩ মে) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনের এটিএম শামসুল হক হলে সেন্টার ফর পলিসি অ্যানালাইসিস অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি (সিপিএএ) আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. এম শাহীদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘের মানবিক করিডোর মূলত একটি ভূরাজনৈতিক পন্থা। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামরিক হস্তক্ষেপের একটি ভিত্তি গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে কৌশলগত ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।’
ড. শাহীদুজ্জামান বলেন, ‘রাখাইনে নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার চিন্তা চালু হয়েছে, যেখানে শুধু মানবিক সহায়তা নয়, বরং একটি নিয়ন্ত্রিত এলাকা তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের সামরিক অংশগ্রহণের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি মার্কিন প্যাসিফিক কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডারের ঢাকা সফর এবং সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক এ ধারণাকে আরও জোরালো করে যে, সামরিক সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ বিষয়ে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘মানবিক করিডোর নিয়ে কোনও বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণায় না গিয়ে বাংলাদেশের উচিত হবে, মিয়ানমার ও আঞ্চলিক কাঠামোর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করা এবং একটি স্বচ্ছ, কৌশলগত অবস্থান তৈরি করা।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট ভূরাজনীতিবিদ ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অতিরিক্তভাবে ভারতনির্ভর হয়ে পড়েছে। এই একমুখী নীতির ফলে দেশ আন্তর্জাতিক পরিসরে কৌশলগতভাবে দুর্বল হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষিত শ্রেণি, সিভিল সোসাইটি এমনকি একাডেমিক পরিমণ্ডলও অনেকাংশে ভারতঘেঁষা নীতিকে সমর্থন করে আসছে। যারা স্বাধীন চিন্তা ও জাতীয় স্বার্থে কথা বলেন, তাদের একঘরে করা হয়।’
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার এবং ‘‘লুক ইস্ট’’ নীতিকে কার্যকরভাবে পুনরুজ্জীবিত করার আহ্বান জানান।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হতে হবে স্বাধীন, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও জাতীয় স্বার্থনির্ভর। চীন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র কারও সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে অযথা ভয় বা বিভ্রান্তি নয়, সম্পর্ক হবে স্বার্থকেন্দ্রিক ও কৌশলগত।’
সভাপতির বক্তব্যে সিপিএএ সভাপতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. এম শরিফুল আলম বলেন, “বাংলাদেশ এখন এলডিসি পরবর্তী বাস্তবতা এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বৈত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। শুধু উন্নয়ন সহযোগিতা নয়, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৌশলগত অংশীদারত্ব জরুরি। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে নতুনভাবে সম্পর্ক রিম্যাপ করার এখনই উপযুক্ত সময়।”
%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%a1%e0%a6%b0-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%b7%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a7%87-%e0%a6%ac%e0%a6%be
Leave a Reply