পরিবর্তনের আহ্বানে নতুন আলোর পথে ঐক্যের ডাক নিয়ে এলো বাঙলা নববর্ষ। আজ সোমবার পয়লা বৈশাখ। সুর-গীত, শোভাযাত্রা আর বহুত্বের আনন্দ আয়োজনে বৈশাখের প্রথম প্রভাতে নতুন বর্ষকে বরণে প্রস্তুত গোটা বাংলাদেশ। বাজবে ঢাকা, বাজবে বাদ্য-বাঁশি, কণ্ঠ উঠবে শিল্পীর, রঙিন পোশাক পরবে বাঙালি, উৎসব হবে দেশজুড়ে। ‘এসো হে বৈশাখ’ অনুরণন তুলবে লাল-সবুজে হৃদয় মোড়া বাংলাদেশে।
চৈত্রসংক্রান্তির মধ্য দিয়ে পুরোনো বছরের বিদায় ঘটিয়ে জরাজীর্ণতা ভুলে নতুন সূর্যোদয় নিয়ে আসবে নবঘন দিন; আজ পয়লা বৈশাখ, বাংলা বর্ষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়বে এই দেশে, আমাদের বাংলাদেশে।
নববর্ষ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বর্ণিল উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে সরকারি, বেসরকারি এবং প্রাতিষ্ঠাকিন, সামাজিক ও পারিবারিক পরিসরে। সুন্দরের আহ্বানে মাঠে-ময়দানে, সাজানো ছাউনিতে, অডিটোরিয়ামে, সরকারি-বেসরকারি ভবন ও প্রাঙ্গণে, রাজপথে, ফুটপাতে, পার্কে, খোলা আকাশের নিচে, বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যাবে বাঙালি খাবারের পসরা আর বিনোদনের বহু আয়োজন। এ জন্য সারা দেশে ব্যাপক প্রস্তুতি দেখা গেছে।
গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তোর আকাঙ্ক্ষায় যে বাংলাদেশের যাত্রা আট মাস আগে শুরু হয়, তারপর এই প্রথম নববর্ষ উদযাপন হচ্ছে। এবারের নববর্ষ বরণের সরকারি-বেসরকারি আয়োজনে সেই পরিবর্তনের ছোয়া লেগেছে; পরিবর্তন এসেছে সাংস্কৃতিক উপস্থাপনার রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বে। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম বদলে রাখা হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’, সমন্বয়ের সেই শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়ার ডাক পড়েছে ২৮টি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের।
নবসূর্যের প্রথম আলোয় নতুন পথের আহ্বান-বন্দনায় সুরে সুরে ভরে উঠবে ছায়াবিথী রমনার বটমূল। ঢাকার সব উদ্যান, বিনোদনকেন্দ্রে বর্ষবরণের প্রস্তুতি দেখা গেছে। ফুলের দোকানে এসেছে হরেক রকম ফুল। হোটেল-রেস্তোরাঁয় বাঙালি খাবারের বিশেষ আয়োজন করা হয়েছে। ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ আজ দেশি খাবারে মন ভরাবে; কেউবা খাবে পান্তা-ইলিশ।
সব আয়োজনের মধ্যে বর্ষবরণের প্রতিপাদ্যে ভাবাদর্শিক পরিবর্তনের ধারা লক্ষ্যণীয়। ঐতিহ্যবাহী ও জাতিসংঘের ইউনেস্কো স্বীকৃত মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম আনন্দ শোভাযাত্রা করার ব্যাখ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, “এই শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্যে দুটো মেসেজ (বার্তা) আছে। একটি হচ্ছে, একটি নিবর্তনমূলক স্বৈরাচারীব্যবস্থার অবসান। রাজনৈতিক ও সামাজিক নিবর্তনমূলক স্বৈরাচারীব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ, সেই বিষয়টি তুলে ধরা। কিছু মোটিফ সেই কাজটি করছে। আর দ্বিতীয় যে অংশটি আছে, সেটি হচ্ছে মূলত ঐক্যের ডাক, সম্প্রীতির ডাক।”
‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ প্রতিপাদ্য নিয়ে পয়লা বৈশাখের সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। বর্ণাঢ্য কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নববর্ষ উদ্যাপনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। এবার বড় জায়গা পেয়েছে ৩৬ জুলাই আন্দোলনের আবহ।
সোমবার সকাল ৯টায় ঢাকার চারুকলা অনুষদ থেকে শুরু হবে আনন্দ শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রার জন্য বানানো ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ পুড়ে যাওয়ার পর সেটি আবার নতুন করে বানিয়েছেন চারুকলার প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা। শনিবার রাতেই থার্মোকল বা শোলা দিয়ে নতুন করে ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি বানানোর কাজ শুরু হয়। নতুন করে তৈরি এই ‘মোটিফটির উচ্চতা ১৬ ফুট। এটিসহ এবার ছোট-বড় মোট ২১টি মোটিফ রাখা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু দিনের ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা অব্যাহত রেখে অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য লোক-ঐতিহ্য ও ২৪ এর চেতনাকে ধারণ করে আরো বড় পরিসরে এবং বৈচিত্র্যপূর্ণভাবে এ বছর শোভাযাত্রায় সর্বজনীন অংশগ্রহণের আয়োজন করা হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
পয়লা বৈশাখের প্রথম প্রভাতে মঙ্গল, মুক্তি ও নতুনের আহ্বানে দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট ঢাকার রমনার বটমূলে অনুষ্ঠানের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। কয়েক ঘণ্টা বাদে ভোরে সেই আয়োজনে একাত্ম হবে দেশ।
ছায়ানটের বর্ষবরণের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা বলেন, “ছায়ানট আয়োজিত বর্ষবরণের এবার ৫৮তম আয়োজন। ছায়ানটের এবারের বার্তা, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। বিশ্বব্যাপী যেমন ক্ষয়ে চলেছে মানবতা, তেমনই এ দেশেও ক্রমান্বয়ে অবক্ষয় ঘটছে মূল্যবোধের। তবু আমরা আশাহত হই না, দিশা হারাই না, স্বপ্ন দেখি, হাতে হাত রেখে সকলে একসঙ্গে মিলবার, চলার। বাঙালি জাগবেই, সবাই মিলে সুন্দর দিন কাটানোর সময় ফিরবেই।”
বাংলা নববর্ষের তাৎপর্য এবং শোভাযাত্রার ইতিহাস, ইউনেস্কোর স্বীকৃতিসহ নানা বিষয়ে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি বিভিন্ন অনুষ্ঠান রেখেছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার প্রস্তুতি নিয়েছে।
বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন ১৪ এপ্রিল, সোমবার সরকারি ছুটি। তবে উৎসবের আবহ সর্বত্র। নতুন দিনে দেশের সব কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলা সাল গণনা শুরু হয়। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন পঞ্জিকার আলোকে প্রবর্তন করা হয় নতুন বাংলা সন।
একসময় বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। তখন নতুন-পুরোনো ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করা হতো এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করা হতো। চিরাচরিত সেই আয়োজন আজো দেখা যায়।
১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথম দিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে। পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে।
পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। এ সময় ঢাকায় নাগরিক পর্যায়ে ছায়ানটের উদ্যোগে সীমিত আকারে বর্ষবরণ শুরু হয়। মহান স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে এই উৎসব নাগরিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।
পয়ালা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। কালক্রমে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এখন শুধু আনন্দ-উল্লাসের উৎসব নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী ধারক-বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এই শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। অবশ্য এবার শোভাযাত্রার নাম বদলে গেছে; করা হয়েছে আনন্দ শোভাযাত্রা।
নাম পরিবর্তনের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. আজহারুল ইসলাম শেখ বলেন, “নাম পরিবর্তনের বিষয়ে আমি পরিবর্তন বলতে চাই না। শুরুতে বর্ষবরণ ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। আগে যেভাবে হয়েছিল, সেটির স্বতঃস্ফূর্ততা কতোখানি ছিল, সেটা বিশ্লেষণের বিষয়। পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার ক্ষেত্রে কী ঘটেছে? এ জন্য পরিবর্তন নয়, পুনরুদ্ধার বলছি আনন্দ শোভাযাত্রাকে।”
তবে এই নাম পরিবর্তন নিয়ে সমালোচনা ও নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টির মধ্যে জরাজীর্ণ-আবর্জনা আর পুরোনোকে পেছনে ফেলে নতুন সূর্যোদয়ে বর্ষবরণে প্রস্তুত বাংলাদেশ।
রমনা বটমূল ও ঢাবিকেন্দ্রিক যেসব সড়ক বন্ধ থাকবে আজ
পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে ট্রাফিক নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে রমনা বটমূল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকায় ভোর ৫টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত কিছু এলাকায় রাস্তা বন্ধ বা রোড ডাইভারশন দেওয়া হবে।
ভোর ৫টা থেকে রমনা পার্ক (রমনা বটমূল), সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও আশপাশের বাংলামোটর ক্রসিং/নেভি গ্যাপ, পুলিশ ভবন ক্রসিং, সুগন্ধা ক্রসিং, কাকরাইল চার্চ ক্রসিং, কদম ফোয়ারা ক্রসিং, হাইকোর্ট ক্রসিং (পূর্ব ও দক্ষিণ), দোয়েল চত্বর ক্রসিং, রোমানা ক্রসিং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার, জগন্নাথ হল ক্রসিং, ভাস্কর্য ক্রসিং, নীলক্ষেত ক্রসিং ও কাঁটাবন ক্রসিং বন্ধ থাকবে বা রোড ডাইভারশন দেওয়া হবে।
গাড়ি চলাচল নির্দেশনা
১। রমনা পার্ক (রমনা বটমূল), সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ডাইভারশন পয়েন্ট ছাড়া মিরপুর-ফার্মগেট থেকে শাহবাগ অভিমুখী যাত্রীবাহী যানবাহন বাংলামোটর ক্রসিংয়ে বামে মোড় নিয়ে মগবাজার ক্রসিং হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে।
২। গোলাপশাহ মাজার ক্রসিং, হাইকোর্ট ক্রসিং থেকে শাহবাগ অভিমুখী যাত্রীবাহী যানবাহন কদম ফোয়ারা ক্রসিং-ইউবিএল ক্রসিং- নাইটেঙ্গল ক্রসিং হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে।
৩। সায়েন্সল্যাব ক্রসিং থেকে শাহবাগ অভিমুখী যাত্রীবাহী যানবাহন মিরপুর রোড দিয়ে আজিমপুর ক্রসিং-চাঁনখারপুল ক্রসিং-বকশীবাজার ক্রসিং হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে।
রাজধানীবাসীকে নির্দেশনা অনুযায়ী রাস্তা-সড়ক ব্যবহার করতে অনুরোধ করেছে ডিএমপি।
%e0%a6%a8%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%a8-%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a7%8b%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%90%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%a1%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a7%87
Leave a Reply