জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে রাজস্ব খাতকে দুটি পৃথক বিভাগে ভাগ করে নতুন অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার। সোমবার (১২ মে) রাতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অনুমোদনের পর ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করা হয়। এতে এনবিআর নামের প্রতিষ্ঠানটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দীর্ঘদিনের কেন্দ্রীয় কাঠামো ভেঙে পৃথক দুটি বিভাগ গঠনের মধ্য দিয়ে রাজস্ব প্রশাসনে এক যুগান্তকারী সংস্কার এলো। এনবিআরের ৫০ বছরের ইতিহাসে এটি প্রথম বড় প্রশাসনিক বিভাজন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংস্কার রাজস্ব প্রশাসনের গতিশীলতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে সহায়ক হবে। তবে বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ ও জটিলতা থাকবে বলেও সতর্ক করছেন তারা।
সরকারি গেজেটের মাধ্যমে বিদ্যমান রাজস্ব কাঠামো পুনর্গঠন করে কর নীতিমালা ও কর আদায় কার্যক্রমকে সম্পূর্ণ আলাদা দুইটি প্রশাসনিক শাখায় রূপ দেওয়া হয়েছে।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের মুদ্রণ ও প্রকাশনা শাখা থেকে প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী, সংবিধানের ৯৩ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এই অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করেছেন, কারণ সংসদ বর্তমানে ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
এনবিআর বিভাজনের মূল উদ্দেশ্য
বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব সংক্রান্ত কার্যক্রমকে দুটি পৃথক বিভাগে ভাগ করে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ এবং ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ গঠন এবং পরিচালনার জন্য একটি নতুন কাঠামো প্রবর্তন।
এরমধ্যে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ কর ব্যবস্থা প্রণয়ন, কর নীতি প্রণয়ন, আইন ও বিধি সংশোধন, গবেষণা ও বিশ্লেষণ, আন্তর্জাতিক চুক্তি বিষয়ে মতামত প্রদান করবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন থাকবে এই বিভাগ। এর আওতায় থাকবে কর আপিল ট্রাইব্যুনাল এবং কাস্টমস আপিল ট্রাইব্যুনাল। পাশাপাশি স্ট্যাম্প ডিউটি, আয়কর, ভ্যাট, কাস্টমস ইত্যাদি নীতিগত বিষয় দেখবে বিভাগটি। একজন সচিব নিয়োগ করা হবে এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত হবে।
আর ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ মাঠপর্যায়ে রাজস্ব আহরণ, বাস্তবায়ন, প্রশাসন, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং আইন প্রয়োগ কাজ করবে। এটি সরাসরি রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকবে। সিভিল সার্ভিসের কর, শুল্ক ও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা এই বিভাগে পদায়ন পাবেন।
রাজস্ব নীতি বিভাগকে সহায়তার জন্য একটি পরামর্শক কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে; যাতে অর্থনীতিবিদ, ট্যাক্স বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী ও সরকারি প্রতিনিধিরা থাকবেন।
গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সিদ্ধান্তে রাজস্ব খাতের দ্বৈত ভূমিকা পৃথক হওয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে। নীতি ও বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ আলাদা হওয়ায় নীতিগত উন্নয়ন ও কার্যকারিতা বাড়ানো সহজ হবে। ভবিষ্যতে বাজেট পরিকল্পনা ও রাজস্ব সংগ্রহে দক্ষতা ও গতি আসবে।
তারা আরও বলছেন, বাংলাদেশের রাজস্ব ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়ন পৃথক হওয়ায় নীতির স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে এটি সফল করতে প্রয়োজন দক্ষ নেতৃত্ব, আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয়, এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
পৃথক বিভাগ, পৃথক দায়িত্ব
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও গবেষণার জন্য ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ এবং রাজস্ব আহরণ, আইন বাস্তবায়ন ও মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম তদারকির জন্য ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ গঠিত হবে। উভয় বিভাগ অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত হবে এবং পৃথক সচিবের নেতৃত্বে কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ গঠনের উদ্দেশ্য হলো কর কাঠামো উন্নয়নে গবেষণাভিত্তিক ও তথ্যনির্ভর নীতি প্রণয়ন নিশ্চিত করা। বিভাগটি কর আইনের সংস্কার, কর অব্যাহতি নীতিমালা, আন্তর্জাতিক কর চুক্তি ও কর প্রক্ষেপণ (forecasting) সংক্রান্ত কাজ করবে। এ বিভাগে অর্থনীতি, আয়কর, ভ্যাট, শুল্ক, পরিসংখ্যান, আইন ও প্রশাসনে অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা নিযুক্ত হবেন।
অন্যদিকে, ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ রাজস্ব আদায়, আইন বাস্তবায়ন, কর আদায়ের সুশাসন এবং মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার কাজ দেখবে। মাঠপর্যায়ে কর্মরত কর ও শুল্ক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এই বিভাগ আইনসমূহ কার্যকর করবে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (কর ও শুল্ক-আবগারি) এবং প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের এ বিভাগে পদায়ন করা হবে।
নীতিগত সংস্কারে গুরুত্ব
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও গতিশীলতা আনতেই এই বিভাজন কার্যকর। রাজস্ব নীতি বিভাগের অধীন থাকবে কর আপিল ট্রাইব্যুনাল ও কাস্টমস আপিল ট্রাইব্যুনাল। পাশাপাশি, এই বিভাগ গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে কর রাজস্ব বৃদ্ধিতে কাজ করবে।
নতুন অধ্যাদেশের আওতায় একটি উচ্চপর্যায়ের পরামর্শক কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে, যেখানে অর্থনীতিবিদ, কর বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, পেশাজীবী এবং সরকারি কর্মকর্তারা থাকবেন। কমিটি রাজস্ব নীতি বিভাগকে নিয়মিত পরামর্শ প্রদান করবে।
কেন প্রয়োজন হয়েছিল বিভাজন?
দীর্ঘদিন ধরেই এনবিআরের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কাজ একই কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হয়ে আসছিল। এতে অনেক সময় স্বার্থের দ্বন্দ্ব, তদবিরের সুযোগ এবং দীর্ঘসূত্রতা দেখা দিতো। নীতিগত চিন্তা ও মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা একসঙ্গে মিশে গিয়ে প্রায়ই রাজস্ব লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থতা দেখা দিত।
বিশ্লেষকদের মতে, নীতি ও ব্যবস্থাপনা এক ছাতার নিচে থাকায় জবাবদিহির ঘাটতি ছিল। উন্নত অনেক দেশেই এই দুইটি বিভাগ আলাদা থাকে, যার মাধ্যমে নীতিনির্ধারক ও বাস্তবায়নকারী দুই পক্ষই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশও সেই পথেই হাঁটলো।
কী বলছে নতুন অধ্যাদেশ?
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদের ক্ষমতা বলে রাষ্ট্রপতি এই অধ্যাদেশ জারি করেন। এতে বলা হয়েছে, কর নীতি নির্ধারণ, সংস্কার, গবেষণা ও আন্তর্জাতিক কর বিষয় দেখভাল করবে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’। অপরদিকে, কর আদায়, আইন প্রয়োগ ও মাঠ প্রশাসনের দায়িত্ব থাকবে ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’-এর হাতে। উভয় বিভাগের নেতৃত্বে থাকবেন পৃথক সচিব।
আশাবাদ বনাম সংশয়
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ দীর্ঘদিন ধরেই এনবিআর সংস্কারের জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। তাদের মতে, নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে সংঘর্ষ থাকলে কর প্রশাসনের দক্ষতা কমে যায়। এ সংস্কার সেই আন্তর্জাতিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতারই ফল।
টিআইবি, সিপিডি ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরই) মতো সংস্থাগুলোর মতে, যদি নীতি বিভাগ যথাযথভাবে গবেষণাভিত্তিক পরিকল্পনা করতে পারে এবং ব্যবস্থাপনা বিভাগ তা দক্ষতার সঙ্গে কার্যকর করে, তবে রাজস্ব জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।
তবে সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যানদের কেউ কেউ বলছেন, ‘একটি প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলা সহজ, কিন্তু নতুন দুটি প্রতিষ্ঠান একযোগে চালু করে কার্যকর রাখা কঠিন।’
সময়ের দাবি পূরণ, নাকি সময়ই বলবে?
বহুদিন ধরেই রাজস্ব প্রশাসনে সংস্কার প্রয়োজন ছিল। এবার সেই কাঠামোগত সংস্কার শুরু হলো। কিন্তু বাস্তবে এই কাঠামো কতটা কার্যকরভাবে রূপ নেয়, সেটিই দেখার বিষয়।
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, সরকার আলাদা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কার্যকর তারিখ ঘোষণা করবে। ফলে প্রশাসনিক প্রস্তুতি এবং জনবল পুনর্বিন্যাসের পরই কার্যক্রম শুরু হবে।
আরও পড়ুন:
এনবিআরের বিভক্তিতে সুফল মিলবে?
%e0%a6%8f%e0%a6%a8%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%86%e0%a6%b0-%e0%a6%ad%e0%a7%87%e0%a6%99%e0%a7%87-%e0%a6%a6%e0%a7%81%e0%a6%87-%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%97-%e0%a6%b9%e0%a6%b2%e0%a7%8b-%e0%a6%85%e0%a6%a7
Leave a Reply