হিজরি নতুন বছর এবং মুহাররম মাস : জীবনের এক আধ্যাত্মিক সফর

মাগরিবের নামাজটা নদী পাড়েই পড়া হলো “নেয়ামত” সাহেবের। রক্তিম লাল আভায় আলোকিত পশ্চিম আকাশ। যত দূর চোখ যায় মনে হয় নদী জুড়ে শুধু তরল সোনা ভেসে বেড়াচ্ছে। দু’একটা জেলে মাঝির নৌকা, যেন বাড়ি ফেরার খুব তাড়া। সেই সাথে ক্ষীণ হতে হতে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে পাখির ডাক। অজপাড়া কোনো গাঁ কিংবা গ্রাম, নতুন দেখতে আসা নেয়ামত সাহেব হাটতে হাটতে নদী ঘাটে গিয়ে বসলেন। সুশীতল বাতাস আর সেই সাথে সন্ধ্যার সৌন্দর্যটুকু ধীরে ধীরে রাতের আধারে মিলিয়ে যাচ্ছে। নেয়ামত সাহেব চারপাশ দেখছে আর ভাবছে এসব জায়গা এতটা সুনশান আর নিরবতা কী থাকে? এসব উপলব্ধি করতে করতে তার চোখ চলে যায় পশ্চিম আকাশে, ঠিক ঈদের চাঁদের মত চিকন এক নতুন চাঁদ যেন হাসছে। নেয়ামত সাহেব উঠে দাড়ালেন, রাতের অন্ধকার আর নির্জনতা বাড়ার আগেই বাড়ীর পথ ধরবেন বলে।

হাটতে হাটতে হঠাৎ নেয়ামত সাহেবের কানে যেন কোনো কথার আওয়াজ ভেসে আসলো। মনে হচ্ছে কোথাও মৃদু শোরগোল হচ্ছে। কৌতূহল বসত তিনি এগিয়ে গেলেন সেই ভেসে আসা আওয়াজের পথ ধরে।

কুপির আলোয় আলোকিত গ্রামের পুরো মাসজিদ, মনে হচ্ছে কেউ কিছু বলছে মিম্বারে দাঁড়িয়ে, আর মাসজিদের সবাই মন দিয়ে তার কথা শুনছে। নেয়ামত সাহেব গিয়ে সকলের সাথে বসলেন। লাঠিতে ভর দিয়ে দাড়ানো মিম্বারের ভদ্রলোক বয়োবৃদ্ধ, সাদা শুভ্র দাড়ি আর মুখে মুচকি হাসি রেখে কথা বলে যাচ্ছেন। নেয়ামত সাহেব গ্রামবাসী একজনের কাছে তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভদ্রলোকের নাম “সুলতান”। তাকে আমরা ধর্মগুরু হিসেবে মানি। নেয়ামত সাহেব এবার একটু আগ্রহ নিয়েই শুনতে লাগলেন।

সুলতান সাহেব বলছেন, ‘আজ হিজরি নতুন বছর আর মুহাররম মাসের প্রথম দিন। এটি শুধু নতুন বছর হিসেবে নয়, বরং এই নতুন বছর আর মুহাররম মাস আমাদেরকে তাওবা করার, আত্মাকে শুদ্ধ করার, আর আল্লাহর কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে।’ নেয়ামত সাহেবসহ পুরো গ্রামবাসী সুলতান সাহেবের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন। তিনি বলছেন আজ আমরা শুধু নতুন বছর শুরু করছিনা, বরং আমাদের জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু করছি। আজকের এই দিন আমাদের শেখায়, আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই অত্যন্ত মূল্যবান হওয়া উচিৎ, আর আমরা যে পথে চলি সে পথ যেন আমাদের আধ্যাত্মিক পথের লক্ষ্যকে পরিপূর্ণ করতে সাহায্য করতে পারে। গ্রামবাসীরা সকলে চুপচাপ শুনতে লাগলো। নেয়ামত সাহেব কিছুটা দ্বিধা ভরা মুখ নিয়ে বৃদ্ধ সুলতান সাহেবকে প্রশ্ন করলেন, নতুন বছর হিসেবে আমাদের কি করা উচিৎ? আর আমরা কিভাবে আমাদের জীবনের আধ্যাত্মিক সফর শুরু করতে পারি? প্রশ্ন শুনে বৃদ্ধ সুলতান সাহেব মুচকি হেসে একটু বসলেন।

সুলতান সাহেবের পাশে বসে থাকা এক ভদ্রলোক এবার তার লাঠিতে ভর করে দাড়ালেন। তারও মুখে সাদা শুভ্র দাড়ি, তবে তিনি মুচকি হাসেন না, মুখ খুলে হাসেন। পুরো মুখ জুড়েই যেন তার হাসি লেগে থাকে। তার পরিচয় জানতে চাইলে এবার একজন বললেন, তিনি “আব্দুল লতিফ” সাহেব, আমরা তাকে আমাদের শিক্ষাগুরু হিসেবে মানি। আব্দুল লতিফ সাহেব সকলের উদ্দ্যেশ্যে ইমাম হুসাইন (রা:) এর শাহাদাতের ঘটনা বর্ননা করতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন হিজরি নতুন বছর, মুহাররম মাস আর ইমাম হুসাইন (রা:) এর শাহাদাত আমাদের শেখায়, কেউ যদি সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে চায় তাকে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। আর সকল বাধা বিপত্তি কখনো সত্যের পথে চলা মানুষকে থামাতে পারেনা, আর জীবনে যে যত বেশি কষ্ট পাবে সে তত বেশি পরিশুদ্ধ হতে পারবে। আর এই চেষ্টাই হতে পারে আমাদের নতুন বছর ও মুহাররম মাসের একমাত্র পাথেয়। এটি শুধুমাত্র নতুন বছর আর নতুন দিনের শুরু নয়, এটি আমাদের জীবনের এক আধ্যাত্মিক যাত্রা, নিজেদের ভুলগুলো শুধরানো, সেই সাথে আল্লাহর পথে নিজেদের জীবনকে নতুন করে পরিচালিত করা। আব্দুল লতিফ সাহেবের এই কথায় গ্রামবাসিরা যেন তাদের জীবনের এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি খুজে পেলো।

নেয়ামত সাহেব উঠে দাড়ালেন, পথ ধরলেন নিজ গন্তব্যের। আর ভাবতে লাগলেন, আচ্ছা মিম্বারে দাঁড়ানো বৃদ্ধ দু’জনের চেহারা কেন বার বার তার মনে পড়ছে? যত দূর পথ যাচ্ছে তাদের দু’জনের সাদা শুভ্র হাসোজ্জল চেহারা কেনো আরো বেশি স্পষ্ট হচ্ছে? আচ্ছা তাদের সাথে কি কোথাও আবারো দেখা হবে?

মুহাম্মদ রিয়াদুল হাসান নুমান
(শিক্ষক-চিন্তক-লেখক)


%e0%a6%b9%e0%a6%bf%e0%a6%9c%e0%a6%b0%e0%a6%bf-%e0%a6%a8%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%a8-%e0%a6%ac%e0%a6%9b%e0%a6%b0-%e0%a6%8f%e0%a6%ac%e0%a6%82-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%b0

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *