রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিদিনই নানা অভিযোগে গ্রেফতার হচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। আবার মামলা থেকে অব্যাহতি কিংবা জামিনেও ছাড়াও পাচ্ছেন অনেকে। তবে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের কেন্দ্রীয় ও জেলা কারাগারগুলোতে বন্দিদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সাধারণ ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ কারাবন্দি কয়েদিকে কারাগারগুলোতে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও পটপরিবর্তনে বিভিন্ন কারণে বন্দির সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
কারা অধিদফতরের রবিবার (১ জুন) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে কেন্দ্রীয় ও জেলাসহ মোট ৭১টি কারাগারের বন্দি ধারণক্ষমতা রয়েছে ৪৩ হাজারের কিছু কম। তবে কারাবন্দি রয়েছেন প্রায় ৭৩ হাজার; যা প্রায় দ্বিগুণ। এর মধ্যে পুরুষ ৭১ হাজার ১৮০ জন এবং নারী কারাবন্দি রয়েছে আড়াই হাজার। অন্যদিকে বিচারাধীন কারাবন্দি বা হাজতির সংখ্যাই ৫৩ হাজার ৯০১ জন। যা মোট কারাবন্দির প্রায় ৭৫ শতাংশ। যাদের মধ্যে আবার অনেকেই বিনা বিচারে দীর্ঘদিন ধরে বন্দি রয়েছেন।
প্রতিদিনই বন্দির সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। সারা দেশে সাধারণ আসামির পাশাপাশি বিভিন্ন মামলায় নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। আদালত থেকে তাদের পাঠানো হচ্ছে কারাগারে। ফলে কারাগারগুলোতে বন্দির সংখ্যা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
এত সংখ্যক বন্দিকে কীভাবে রাখা হচ্ছে কিংবা তাদের থাকা-খাওয়াই বা কী হচ্ছে—এ বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, কারাবিধি অনুযায়ী একজন বন্দি থাকার জন্য ন্যূনতম ছয় ফুট করে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের জায়গা থাকতে হয়। কারাগারে সেটা মানা সম্ভব হচ্ছে না। কারাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দি রাখতে হয় বলে তারা কারাবিধি মানতে পারেন না। এছাড়া কারাগারে যথেষ্ট কারারক্ষী না থাকায় শৃঙ্খলা রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে এতগুলো কারাগারের জন্য চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ছয় জন। এছাড়াও কারাবন্দিদের দেখভালে প্রয়োজনের তুলনায় লোকবল সংকটও রয়েছে।
বর্তমানে দেশে ১৫টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৬টি জেলা কারাগার রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কারাবন্দি রয়েছে ঢাকা বিভাগে। এই বিভাগে মোট ১৮টি কারাগারে ধারণক্ষমতা ১৩ হাজার ৩১২ জন, যেখানে বন্দি রয়েছে ২৫ হাজার ৩৭৩ জন। যা মোট বন্দির ৩৫ শতাংশ এবং ধারণক্ষমতার ১ দশমিক ৯২ গুণ বেশি।। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। এই বিভাগে ১১টি কারাগারে ৬ হাজার ৯৫০ জনের জায়গা রয়েছে, যেখানে বন্দি আছে ১৪ হাজার ৫০৯ জন। যা মোট বন্দি সংখ্যার ২০ শতাংশ, তবে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি। অন্যদিকে সবচেয়ে কম বন্দি রয়েছে রংপুর বিভাগে। এ বিভাগের আটটি কারাগারে ৫ হাজার ১৭৯ জনের ধারণক্ষমতার বিপরীতে বন্দি রয়েছে ৪ হাজার ৯০৮ জন।
এছাড়াও রাজশাহী বিভাগের ৪ হাজার ১৭৯ জনের বিপরীতে কারাবন্দি রয়েছে ৯ হাজার ৪২০ জন। সেখানে একজনের জায়গায় ২ দশমিক ২৫ জন বন্দি রয়েছে। ময়মনসিংহে চারটি কারাগারে এক হাজার ৮০৩ জনের বিপরীতে কারাবন্দি রয়েছে ৩ হাজার ৯৯৭ জন। যা একজন বন্দির জায়গায় ২ দশমিক ২১ জন। বরিশালে ছয়টি কারাগারে এক হাজার ৯৩৩ জনের বিপরীতে বন্দি রয়েছে ২ হাজার ৮৫৬ জন। যেখানে একজনের জায়গায় ১ দশমিক ৪৭ জন কারাবন্দি। খুলনা বিভাগে ১০টা কারাগারে ৫ হাজার ৬৯ জনের জায়গায় বন্দি রয়েছে ৬ হাজার ৫৬৬ জন। সিলেট বিভাগে ৫টি কারাগারে ধারণক্ষমতা রয়েছে ৪ হাজার ৪৮২ জন। আর বন্দি রয়েছে ৪ হাজার ৫৭৭ জন।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিধি অনুযায়ী যে সংখ্যক বন্দি থাকার কথা, সেখানে আছে তার তিন গুণ। একজন বন্দির জন্য পর্যাপ্ত জায়গার দরকার হয়, যেহেতু তারা বন্দি অবস্থায় থাকেন। কারারক্ষীর সংখ্যাও কম। এ কারণে বন্দি ব্যবস্থাপনা করা কিছুটা কঠিন হয়ে পড়েছে।
কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কর্মকর্তা বলেন, এখানে বন্দি ধারণক্ষমতা ১ হাজার জন, যেখানে রয়েছেন আড়াই হাজারের মতো। কারাগারটির জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা বলেন, ‘হাইসিকিউরিটি কারাগারের একেকটি সেলে একজন করে বন্দি থাকার কথা। কিন্তু আছে দ্বিগুণের বেশি। তাই একেক সেলে দুই-তিন জন করে রাখতে হচ্ছে। নারী বন্দিরাও দুর্দশায় আছেন। কাশিমপুর মহিলা কারাগারের ধারণক্ষমতা ২০০ জন, যেখানে বন্দির সংখ্যা ৬২১।
কারাগারগুলোতে হাজতি বন্দি প্রায় ৫৪ হাজার, যা মোট বন্দির ৭৫ শতাংশ। যাদের মামলার বিচার শেষ হয়নি, তাদের হাজতি বন্দি বলে। দেখা যায়, বিচার দীর্ঘ সময় ধরে চললেও অনেকে কারাগারে আটকে থাকেন। জামিন পাচ্ছেন না। অন্যদিকে খুনের মামলার আসামিরাও জামিন পান বলে অভিযোগ রয়েছে।
কারা অধিদফতর এআইজি প্রিজন (মিডিয়া) মো. জান্নাত-উল ফরহাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কারাবন্দির ধারণক্ষমতা বাড়াতে ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, খুলনা, নরসিংদী ও জামালপুরে পৃথক পাঁচটি কারাগার নির্মাণের কাজ চলছে। যা দ্রুততম সময়ে শেষ করে কারাবন্দিদের রাখা যাবে। এসব নির্মাণাধীন কারাগারগুলোর কাজ শেষ হলে বন্দি ধারণক্ষমতা বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ব্যাপকভাবে গ্রেফতার করা বন্ধ করে, আসামিদের সহজে জামিন দিয়ে এবং দ্রুত বিচার শেষ করার পর খালাসপ্রাপ্তদের মুক্তি দিয়ে কারাগারে মানবেতর পরিস্থিতি ঠেকানো যায়।
কারা অধিদফতরের ওয়েবসাইটে অভীষ্ট (ভিশন) হিসেবে বলা হয়েছে, ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’। লক্ষ্য (মিশন) হিসেবে বন্দিদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করা, যথাযথভাবে তাদের বাসস্থান, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং একজন সুনাগরিক হিসেবে সমাজে পুনর্বাসনের জন্য উৎসাহ ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
বন্দিদের গাদাগাদি করে রেখে, চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবা যথাযথভাবে না দিয়ে কি ‘সুনাগরিক হিসেবে সমাজে পুনর্বাসন’ করা সম্ভব! জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কারাগার সংশোধনের জায়গা হলেও সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, বন্দিরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এখন তো অবস্থা আরও খারাপ। বন্দি বেশি হলে কোনও সেবাই যথাযথভাবে পাওয়া যায় না। এমনকি শৌচাগারে যেতেও লাইন ধরে থাকতে হয়।
এ সংকটের সমাধান কী— জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারাগারে বিচারাধীন বন্দির সংখ্যাই বেশি। ফলে অতিরিক্ত বিচারক ও আদালত স্থাপনের মাধ্যমে দ্রুত বিচার কার্যক্রম শেষ করা এবং সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের আলাদাকরণ করে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে তাদের সাজা শেষে জীবনযাপন করার জন্য কিছু অর্থ উপার্জন করতে পারে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কারা অধিদফতরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত বন্দি থাকায় তাদের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা বাড়ছে। এসব সমস্যা সমাধানে কারা অধিদফতর থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে জামিনপ্রাপ্তদের দ্রুত ছেড়ে দেওয়া, কারাগারকে সংশোধনাগার হিসেবে রূপান্তর করা এবং মাদক ও সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের আলাদাকরণ করা হচ্ছে।
কর্নেল মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল আরও বলেন, কারাবন্দিদের নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের দেখাশোনা করার জন্য আমাদের আরও ১ হাজার ৮৯৯ জন জনবল বাড়ানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সেইসঙ্গে কারাবন্দিদের কর্মসংস্থানের জন্য সাভারে একটি কারখানা নির্মাণ করা হচ্ছে। যেখানে সাজাকালীন সময়ে বন্দিরা কাজ করে তাদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করতে পারবেন। তারা কারাগার থেকে বের হতে পারবেন একটি আদর্শ নিয়ে।
%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%87-%e0%a6%a7%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%a3%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b7%e0%a6%ae%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac
Leave a Reply