দাউদকান্দিতে ব্যাপক আকারে ছড়ালো ডেঙ্গু, আক্রান্তের হিসাবে বড় গরমিল

কুমিল্লার দাউদকান্দি পৌর এলাকায় ব্যাপক আকারে ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। প্রতি ঘরেই আছে রোগী। গত দেড় মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অন্তত আট জনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ রবিবার ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুরুল আমিন (৫৫) নামের এক ব্যবসায়ী মারা যান। একই সময়ে দেড় হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হন।

কিন্তু সরকারি হিসাবে এসব তথ্য উল্লেখ নেই। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, উপজেলায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে চার জনের। আর গত ১ জুন থেকে ২১ জুন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৬৫ জন। 

এদিকে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতিমধ্যে পৌরসভার দুটি ওয়ার্ডকে গত বুধবার থেকে ‘হটস্পট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে ২৫ জন করে দুটি দল গঠন করে এলাকায় পরিচ্ছন্নতা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।

এক হাজার ৬০০ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন

দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, গত ১ মে থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দাউদকান্দি ২০ শয্যা হাসপাতালে অন্তত এক হাজার ৬০০ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন ১১৫ জন। তাদের মধ্যে ৩৭ জন পৌর এলাকার দোনারচর গ্রামের এবং ২২ জন সবজিকান্দি গ্রামের বাসিন্দা। এসব রোগীর মধ্যে ২৮ জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ১ মে থেকে গত বুধবার পর্যন্ত দুই শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের একটি সূত্রে জানা গেছে, দাউদকান্দিতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি দেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে সবচেয়ে খারাপ। পৌর এলাকার সব ঘরেই কেউ না কেউ আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেকে ছাড়ছেন এলাকা। তবে এসবের কিছুই জানে না সরকারি কোনও দফতর। তাই পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও নিতে পারছেন না স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।

পরিবার ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত ১৯ মে দাউদকান্দি পৌরসভার দোনারচর গ্রামের নাজির আহমেদ চৌধুরীর স্ত্রী সালমা আক্তার (৫২) ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর ২৫ মে দোনারচর গ্রামের নাজিম উদ্দিন (৫৫), ৭ জুন সবজিকান্দি গ্রামের প্রয়াত মতি মিয়ার স্ত্রী মাফিয়া বেগম (৬৫), ১৩ জুন দোনারচর গ্রামের রাসেল সরকারের স্ত্রী শাহীনুর আক্তার (২৩) ও দোনারচর গ্রামের ইউসুফ সরকার (৫৫), ১৭ জুন উপজেলার হাড়িযালা গ্রামের দুলাল মিয়ার স্ত্রী কাকলী আক্তার (৪৬), ১৯ জুন পৌর সদরের গৃহবধূ লিমা আক্তার (২৪) এবং সর্বশেষ রবিবার নাগেরকান্দি গ্রামের ব্যবসায়ী নুরুল আমিন (৫৫) ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‌‘আমরা দাউদকান্দির অন্তত ৩৪টি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে খবর নিয়ে দেখেছি এক হাজার ৬০০ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এখনও অনেকে চিকিৎসাধীন। যা সরকারি হিসাবে নেই।’

রবিবার জেলায় ২৪ জনের ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর জানিয়েছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। কিন্তু এদিন শুধু দাউদকান্দিতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৯৪ জন। অথচ সরকারি হিসাবে দেখানো হয়েছে, দাউদকান্দিতে মাত্র চার জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।

জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর কুমিল্লায় ২৫০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৭ জুন চার, ১৮ জুন ২২, ১৯ জুন ১০, ২০ জুন দুই এবং ২১ জুন ২৪ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, রোগীর সংখ্যা অন্তত দুই হাজারের বেশি।

কেন সরকারি হিসাবে বড় গরমিল

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারি ওয়েবসাইটে রোগীর তথ্য আপলোড করতে বিস্তারিত দিতে হয়। কিন্তু সবসময় রোগীর বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। কেবল সরকারি হাসপাতালে যেসব রোগী আসে তার তথ্য ওয়েবসাইটে আপলোড করতে পারি। এর বাইরে বেসরকারি হাসপাতালে যেসব রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়, সে তথ্য আমরা পাই না। অনেক সময় বেসরকারি হাসপাতাল তথ্য দেয় না। আবার অনেক হাসপাতাল দিতে চাইলেও লোকবল সংকটের কারণে নিতে পারি না।’

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘দাউদকান্দিতে আট জনের মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে সার্বক্ষণিক কাজ করছি আমরা। তবে দাউদকান্দিতে আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে সরকারি আর বেসরকারি হিসাবের কোনও মিল নেই। আমরা বিষয়টি সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (আইইডিসিআর) জানিয়েছি। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করছি। আমরা শুধু দাউদকান্দির তথ্য পাচ্ছি। পুরো জেলার কোনও তথ্য পাচ্ছি না।’

তথ্যে গরমিলের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা সিভিল সার্জন ডা. আলী নুর মোহাম্মদ বশীর আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দাউদকান্দিতে আমি নিজেই গিয়েছি। ডেঙ্গু পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আমরা পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন সাব-সেন্টারকে নির্দেশনা দিয়েছি।’

সরকারি হিসাবে সব রোগীর তথ্য না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা সরকারি হিসাবে আসলেই খুব কম। তবে আমরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়েছি। সেখানে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। আমরা সেটি সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (আইইডিসিআর) জানিয়েছি।’

যে ব্যবস্থা নিলো স্বাস্থ্য বিভাগ

সিভিল সার্জন আলী নুর মোহাম্মদ বশীর আহমেদ ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান জানান, তারা নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। সচেতনতামূলক প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা সচেতন করছেন। এ ছাড়া বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার রাখা, দীর্ঘদিন জমে থাকা পানি সরিয়ে ফেলা ও মশক নিধনের জন্য ওষুধ ছিটানোর কথা বলেছেন। উপসর্গ দেখা দিলে হাসপাতালে আসার জন্য বলছেন।


%e0%a6%a6%e0%a6%be%e0%a6%89%e0%a6%a6%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%87-%e0%a6%ac%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%aa%e0%a6%95-%e0%a6%86%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b0

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *