বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া। সেখানেই রয়েছে কবির ব্যবহার করা নানা স্মৃতিচিহ্ন। এগুলো এখন কোথায় থাকবে, তা নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নজরুল একাডেমী ও নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়।
কবির জন্মভিটার সেই পুরোনো মাটির বাড়িটি ১৯৫৬ সালে ভেঙে ফেলে ১৯৫৮ সালে সেখানেই বানানো হয় একটি বহুতল ভবন, যা নজরুল একাডেমী নামে পরিচিত।
এই নজরুল একাডেমীর নিচতলায় রয়েছে একটি সংগ্রহশালা। এখানে রয়েছে কবির হাতে লেখা পান্ডুলিপি, প্রথম প্রকাশিত গল্প, কবিতা ও গানের পত্রিকার কপি, তার ব্যবহৃত পোশাক, বাদ্যযন্ত্র, বিভিন্ন সময়ে পাওয়া সন্মাননা, প্রমিলা দেবীর ব্যবহৃত খাটসহ আরো অনেক কিছু।
আর একাডেমীর ভবনের দেয়ালে রয়েছে কবির বিভিন্ন সময়ের ছবি। ওই সংগ্রহশালায়ে রয়েছে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট কবির মৃত্যুর দিনের বিভিন্ন আলোকচিত্র। বছরজুড়ে তা দেখতে এই একাডেমীতে ভিড় জমান সাধারণ মানুষ।
কিন্তু কবির সেসব স্মৃতিচিহ্ন ওই জেলারই আসানসোলে অবস্থিত কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করে সরব হয়েছে একাডেমীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি সামনে আসতেই চুরুলিয়া গ্রামের বাসিন্দারা ক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছেন।
তাদের দাবি, কোনো অবস্থায় এসব জিনিস গ্রামের বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। যদিও বিতর্ক ওঠার পরই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে মিউজিয়ামকে বিশ্বমানের করে তোলার লক্ষ্যেই সেটি সংস্কারের কাজে হাত দেওয়া হবে। তাই আপাতত মিউজিয়ামে থাকা কবির ব্যবহৃত জিনিসপত্র নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। সংস্কারের কাজ শেষ হলেই তা পুরনো জায়গায় রেখে আসা হবে।
চুরুলিয়া নজরুল একাডেমীর সংগ্রহশালা থেকে কবির সমস্ত জিনিসপত্র কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে সোমবার (৭ জুলাই) চুরুলিয়ায় সাংবাদিক সম্মেলন করেন কবির ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী আলি রেজা।
কাজী আলি রেজা বলেন, “শুধু ভারতবর্ষ নয়, এমনকি বাংলাদেশ থেকেও প্রতিবছর বহু মানুষ এই মিউজিয়াম দেখতে আসেন। সকলেরই এই মিউজিয়াম দেখার প্রতি একটা আগ্রহ থাকে। কিন্তু বর্তমানে সেই মিউজিয়ামটাকেই বলা হচ্ছে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। অর্থাৎ এই মিউজিয়ামে থাকা কবির ব্যবহৃত জিনিসপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।”
“কিন্তু আমরা বলেছি এটা কোনো মতেই সম্ভব নয়। এরই মধ্যে এক ট্রাক ভরে সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আরেকটি ট্রাক ভরে সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা সেটা বাধা দিয়েছি।”
কাজী আলি রেজা বলেন, “কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সাধন চক্রবর্তীর উপস্থিতিতে একবার বৈঠকে ঠিক হয়েছিল নজরুল একাডেমী থেকে কোনো জিনিসই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যাওয়া হবে না, বরং এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল অন্য কোনো জায়গা থেকে কবির ব্যবহৃত জিনিসপত্র যেন সংগ্রহ করে আমরা এই মিউজিয়ামে রাখতে পারি। এর বদলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই মিউজিয়ামে যে জিনিসগুলো সংগ্রহ করে রেখেছি, সেগুলোই অন্যত্র চলে যাচ্ছে।”
কাজী আলি রেজা আরো বলেন, “নজরুল মেলা উপলক্ষে কয়েকদিন আগেই আসানসোলের তৃণমূল সাংসদ শত্রুঘ্ন সিনহা কবি নজরুলের বাড়িটি সংস্কারের জন্য ১০ লাখ রুপি আর্থিক সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছিলেন। পাশাপাশি পাণ্ডবেশ্বরের বিধায়ক নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীও আলাদা করে ৫ লাখ রুপি আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই অর্থ কোথায় গেল, কী কাজ হয়েছে; তা এখনো আমাদের জানা নেই।”
“জানালা-দরজা ভেঙে পড়ছে, লাইট পাওয়া যায় না; দেওয়ালের রং চাইলে পাওয়া যায় না। এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলেই তাদের দায় এড়াচ্ছেন। এই অবস্থায় আমরা সাধারণ মানুষের মতামত নিচ্ছি, যাতে কোনোভাবেই এই নজরুল একাডেমী বা এই সংগ্রহশালার কোনো জিনিস নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় না চলে যায়,” যোগ করেন তিনি।
কাজী আলি রেজার অভিমত, কবিতীর্থ চুরুলিয়া মানুষের কাছে একটি আবেগ। কবির মিউজিয়াম থেকে সেসব জিনিস বিশ্ববিদ্যালয় চলে গেলে, এটা অন্ধকার হয়ে যাবে। তখন আর কোনো মানুষ এখানে আসবেন না।
এ দিনের সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নজরুলের ভ্রাতুষ্পুত্র রেজাউল করিমের মেয়ে এবং নজরুল অ্যাকাডেমীর সঙ্গে যুক্ত সংগীতশিল্পী সোনালি কাজীসহ স্থানীয় বাসিন্দারাও।
অন্যদিকে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার ড. চন্দন কোনার বলেন, “নজরুল একাডেমীর এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। নজরুল একাডেমী, কবির বাস্তুভিটা, সংগ্রহশালা সবকিছুই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির উদ্যোগে চুরুলিয়ায় একটি সংস্কারের কাজ চলছে। এর জন্য দেড় কোটি রুপি বরাদ্দ করা হয়েছে। রাজ্য সরকারের পর্যটন বিভাগ এই পুরো প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে ধীরে ধীরে কবির ভিটাবাড়ি, সংগ্রহশালা সংস্কার হবে।”
“আর সেই কথা মাথায় রেখেই সংগ্রহশালায় থাকা কবির পান্ডুলিপিসহ অন্য জিনিসপত্র সংরক্ষণ এবং সুরক্ষিত রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আসা হচ্ছে। সংস্কারের কাজ সম্পন্ন হলে ফের কবির ব্যবহৃত জিনিসপত্র ওই সংগ্রহশালায় রেখে দেওয়া হবে। মূলত ওই মিউজিয়াম থেকে বিশ্বমানের করে তোলার লক্ষ্যেই রাজ্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে।”
ড. চন্দন বলছেন, “নজরুল কারো ব্যক্তিগত বিষয় নয়। সারা বিশ্বের লোক নজরুলকে নিয়ে কাজ করছেন। আমার মনে হয়, কিছু মানুষ কবির পরিচয় দিয়ে এই সব বিষয় নিজেদের কাছে কুক্ষিগত করে রাখতে চাইছেন।”
%e0%a6%95%e0%a6%ac%e0%a6%bf-%e0%a6%a8%e0%a6%9c%e0%a6%b0%e0%a7%81%e0%a6%b2%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%9a%e0%a6%bf%e0%a6%b9%e0%a7%8d%e0%a6%a8
Leave a Reply