পবিত্র ঈদ উল আযহা মুসলিম উম্মাহর জন্য ত্যাগের এক মহান উপলক্ষ। এই দিনে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানি করা হয়। তবে কোরবানির রীতিনীতি পালনের পাশাপাশি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, যা সঠিকভাবে পালন করা অত্যন্ত জরুরি। ইসলামি আদর্শ, সামাজিক সচেতনতা এবং পরিবেশগত দিক বিবেচনায় কোরবানির দিন যে কাজগুলো অবশ্যই করা উচিত, তা নিচে তুলে ধরা হলো:
১. ফজরের নামাজ ও ঈদের নামাজ আদায়
কোরবানির দিনের শুরুটা হোক ইবাদতের মাধ্যমে। ফজরের নামাজ আদায়ের পর গোসল করে, পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করে ঈদের নামাজ আদায় করা সুন্নত। ঈদের নামাজ ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল, যা রাসূল (সা.) নিজে আদায় করতেন এবং অন্যদেরকেও করতে উৎসাহ দিতেন। নামাজ শেষে মুসলমানরা একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি ও শুভেচ্ছা বিনিময় করে, যা সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করে।
২. পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা
ইসলাম পরিচ্ছন্নতাকে ইমানের অঙ্গ হিসেবে দেখেছে। কোরবানির দিন ঘর ও নিজের শরীর পরিচ্ছন্ন রাখা যেমন জরুরি, তেমনি পশু জবাইয়ের স্থান, সরঞ্জাম এবং পরিবেশ পরিষ্কার রাখা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জবাইয়ের আগে ও পরে হাত ধোয়া, রক্ত মুছে ফেলা, মাংস পরিষ্কারভাবে সংরক্ষণ করা ও ব্যবহৃত জায়গা ধুয়ে ফেলা – সবকিছুই স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য।
৩. শরিয়ত মোতাবেক পশু জবাই
কোরবানির পশু নির্বাচনে ইসলামি বিধান অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। পশু হতে হবে নির্দিষ্ট বয়সের, সুস্থ ও দাগহীন। গরু, ছাগল, ভেড়া, উট – যেকোনো হালাল পশু কোরবানি করা যাবে, তবে তাতে যেন কষ্ট না হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরি। জবাইয়ের সময় কিবলার দিকে মুখ করে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলা এবং ধারালো ছুরি ব্যবহার করা আবশ্যক। কোরবানির মাধ্যমে পশুকে কষ্ট না দিয়ে দ্রুত ও সুশৃঙ্খলভাবে জবাই করাই ইসলামের শিক্ষা। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন: “আদম সন্তানের কোনো কাজ কোরবানির দিনে আল্লাহর নিকট কোরবানির রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে অধিক প্রিয় নয়। নিশ্চয় কিয়ামতের দিন কোরবানির পশু তার শিং, খুর ও পশমসহ উপস্থিত করা হবে। আর কোরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর নিকট পৌঁছে যায়। অতএব, খুশি মনে কোরবানি করো।” (জামে তিরমিজি, হাদীস: ১৪৯৩)
৪. মাংস তিন ভাগে বণ্টন করা
কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করার নিয়ম ইসলামে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: এক ভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের জন্য এবং এক ভাগ গরিব-দুঃখীদের জন্য। এই বণ্টনের মাধ্যমে সমাজে ধনী ও গরিবের মাঝে একটি সেতুবন্ধ তৈরি হয় এবং ঈদের আনন্দ সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। মাংস বণ্টনের সময় যেন আত্মীয়স্বজন বা প্রতিবেশীদের বাদ না পড়ে, সে দিকেও খেয়াল রাখা জরুরি।।
৫. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা
প্রতিবছর কোরবানির পর শহরের অলিগলিতে পশুর রক্ত, হাড় ও চামড়ার স্তূপ দেখা যায়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তাই কোরবানির পরপরই বর্জ্য যথাস্থানে ফেলা এবং স্থানটি পরিষ্কার রাখা একটি নাগরিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। অনেক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান এই কাজে সহায়তা করে, তাদের নির্দেশনা অনুসরণ করাও জরুরি। প্রয়োজনে জীবাণুনাশক ছিটানো, পানির ব্যবস্থার মাধ্যমে দুর্গন্ধ ও মশা-মাছি থেকে মুক্ত থাকা যেতে পারে।
৬. প্রতিবেশী ও অসহায়দের প্রতি হাত বাড়িয়ে দেয়া
কোরবানির প্রকৃত শিক্ষা হলো ত্যাগ ও সহানুভূতি। সমাজের অনেক মানুষ কোরবানি করার সামর্থ্য রাখেন না। তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া এই দিনের অন্যতম সৌন্দর্য। বিশেষ করে প্রতিবেশী, গৃহকর্মী, পথশিশু কিংবা আশপাশে থাকা দরিদ্র মানুষদের মধ্যে মাংস বিতরণ করলে তা কেবল সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং একটি ইবাদত হিসেবেও বিবেচিত হয়।
৭. দোয়া ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায়
কোরবানি শেষ হলে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করা এবং নিজের ও পরিবারের জন্য দোয়া করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহান আল্লাহ যেন আমাদের ত্যাগ কবুল করেন, আমাদের জীবনে বরকত দান করেন – এ দোয়া করা কোরবানির আনন্দকে পরিপূর্ণ করে তোলে। এই দিনটি আত্মশুদ্ধি ও আত্মিক উন্নয়নের এক অনন্য সুযোগ।
শুধু পশু জবাইয়ের মধ্যেই কোরবানির দিন সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি সামগ্রিক ইবাদতের দিন, যেখানে আছে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, সামাজিক দায়িত্ববোধ, পরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশ রক্ষার শিক্ষা। এই বিশেষ দিনে আমাদের আচরণ, ইবাদত এবং মানুষের প্রতি দায়িত্বশীলতা যেন ইসলামের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলে – সেটাই হোক সকলের লক্ষ্য।
%e0%a6%95%e0%a7%8b%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%b0-%e0%a6%a6%e0%a6%bf%e0%a6%a8-%e0%a6%af%e0%a7%87-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%97%e0%a7%81%e0%a6%b2%e0%a7%8b-%e0%a6%85
Leave a Reply